ট্রেডিশনাল মেডিসিন সিস্টেম (কুসংস্কার এবং বাস্তবত)
আমাদের সমাজে কমপক্ষে ৯৫ শতাংশের ও বেশি মানুষের ট্রেডিশনাল মেডিসিন সম্পর্কে বিস্তর ধারনা নেই বললেই চলে। তাই অনেকে ভেবে থাকেন ট্রেডিশনাল মেডিসিন সিস্টেম স্বল্প পরিসরে এবং অল্পকিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসা দিয়ে থাকে। অনেকে তো ভাবেন কেবল যৌনরোগ এবং কিছু কিছু চর্মরোগ ছাড়া ট্রেডিশনাল মেডিসিনের অন্যকোন ভুমিকা নেই!!
এর অবশ্য কিছু কারন ও রয়েছে। মডার্ন কন্টেম্প্রোরারি মেডিসিনের তুলনায় বাংলাদেশে ট্রেডিশনাল মেডিসিন সিস্টেমের এডভার্টাইজিং (পজিটিভ) এবং মার্কেটিং নেই বললেই চলে। গুগল এর মাধ্যমে বিভিন্ন অল্টারনেটিভ/ট্রেডিশনাল মেডিসিন সম্পর্কে জানার জন্য কি ধরনের কী-ওয়ার্ড সার্চ করতে হবে তাও বেশির ভাগ মানুষের জানা নেই। যদিও কয়েকজন সার্চ করে থাকেন কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমান ইনফরমেশন না থাকায় ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলেন ।
যেকোন ট্রেডিশনাল মেডিসিন সিস্টেম হতে পারে সেটা আয়ুর্বেদ, ইউনানী, হোমিওপ্যাথি (অল্টারনেটিভ), সিদ্ধা, ন্যাচারোপ্যাথি, টিসিএম কিংবা প্রোফেটিক মেডিসিন প্রত্যেকটির বিস্তৃতি কত বিশাল তা কেবল তারাই জানেন, যারা এই সিস্টেমের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন এবং যাদের এই সিস্টেমের প্রতি পর্যাপ্ত পরিমান ইন্টারেস্ট আছে। একজন আয়ুর্বেদিক মেডিসিন এর স্টুডেন্ট হিসেবে আয়ুর্বেদার বিস্তৃতি সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ননা করার চেষ্টা করবো।
যেকোন ট্রেডিশনাল মেডিসিন সিস্টেমে ব্যাসিক নলেজ (ব্যাচেলর লেভেল) অর্জন করতে হলে দেশ এবং কারিকুলাম ভেদে মিনিমাম ৫-৬ বছরের প্রয়োজন হয়, পরবর্তিতে এমডি এবং পিএইচডি করতে আরো ৭-১০ বছরের প্রয়োজন পরে। অর্থাৎ ডক্টরেট লেভেল পর্যন্ত যেতে কমপক্ষে ১২-১৬ বছর লেখাপড়া করতে হয়। এখানেই কোন একটি ট্রেডিশনাল মেডিসিন সিস্টেমের বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। চলুন আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক;
ট্রেডিশনাল মেডিসিন সিস্টেমের বিস্তৃতি কতটুকু, আয়ুর্বেদ পার্সপেকটিব এ এর উত্তর টা জেনে নেওয়া যাকঃ
আয়ুর্বেদায় মোট ৮ টি ব্রাঞ্চ রয়েছে, যাকে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ বলে।
১. কায়া চিকিৎসা
২. বালা চিকিৎসা
৩. গ্রহ চিকিৎসা
৪. উর্ধ্বাঙ্গ চিকিৎসা
৫. শল্য চিকিৎসা
৬. দামস্ত্রা চিকিৎসা
৭. জারা চিকিৎসা
৮. বৃষ্যা চিকিৎসা
?কায়া চিকিৎসাঃ কায়া শব্দের অর্থ হচ্ছে শরীর। কায়া চিকিৎসকরা শরিরের নর্মাল ফাংশনিং (ফিজিওলজি) ঠিক রাখার জন্য মেডিসিন এবং আহার, বিহার প্রেসক্রাইভ করে থাকেন। মডার্ন কন্টেমপ্ররারি বা এলোপ্যথি মেডিসিনে আমরা যাদের মেডিসিন স্পেশালিস্ট বলে থাকি, আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতিতে তাদের কায়া চিকিৎসক বলে।
?বালা চিকিৎসাঃ শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ এমবিবিএস, এমডি এরকম সাইনবোর্ড প্রায়-ই দেখে থাকবেন। কখনো কি বালারোগ বিশেষজ্ঞ কিংবা কৌমারভৃত্ব বিশেষজ্ঞ এমন কিছু দেখেছেন? কমন এন্সার, না। কেননা বাংলাদেশে আদৌ এমডি ইন বালারোগ/কৌমারভৃত্ব আছেন কিনা সন্দেহ। কেননা দেশে এমডি ইন আয়ুর্বেদা এর সুযোগ এখন পর্যন্ত নেই। ভারতে অনেকে জায়গায়-ই এরকম সাইনবোর্ড দেখতে পাবেন, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে। আমাদের ভার্সিটিতেও কৌমারভৃত্ব ডিপা্র্টমেন্টে প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন এমডি এবং পিএইচডি স্কলার্স পড়ালেখা করছেন। আশা করি আয়ুর্বেদায় শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের অবদান কতটুকো তা সম্পর্কে আইডিয়া দিতে পেরেছি।
?গ্রহ চিকিৎসাঃ সাইকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি এবং এস্ট্রোলজি এর সমন্বয় হচ্ছে গ্রহচিকিৎসা। কাউন্সিলিং এবং জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কিত জ্ঞানের বিস্তর ভান্ডার হচ্ছে গ্রহ চিকিৎসা। এই ব্রাঞ্চের আন্ডারে ইন্ডিয়ায় এমডি ইন মনোবিজ্ঞান এবং মানসরোগ (সাইকোলজি) বেশ কয়েকটি ভার্সিটিতে পড়ানো হয়।
?উর্ধ্বাঙ্গ চিকিৎসাঃ উর্ধ্বাঙ্গ শব্দের অর্থ আমরা সবাই জানি, উর্ধ্ব+অঙ্গ যা দ্বারা নাক, কান, গলা, জিহবা, মাথা (মস্তিষ্ক) এবং চোখ (ক্লাভিকল এর উপরে যেসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে সব)। নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞের অহরহ এডভার্টাইজিং দেখা যায় বাংলাদেশে তবে তা সব-ই এলোপ্যাথি। আয়ুর্বেদা তে-ও এই ব্রাঞ্চটি রয়েছে এবং বেশ কার্যকরি চিকিৎসা দিয়ে থাকে।
?শল্য চিকিৎসাঃ আপনার হাতের মোবাইলে যদি ইংলিশ টু বাংলা ডিকশনারি থেকে থাকে তাহলে সার্জারি (surgery) এর বাংলা অর্থটা দেখে নিন। কি, উত্তর শল্য চিকিৎসা আসছে তাই না? আমরা আসলে সার্জারি শব্দটা শুনতে শুনতে এতোটাই অভ্যস্ত হয়েছি যে এর বাংলা মিনিং ও অনেকে জানি না। মডার্ন মেডিসিনের টার্মেনোলজি গুলো যেমন ইংলিশ, ল্যাটিন এবং অন্যান্য ভাষায় তেমনি আয়ুর্বেদার টার্ম গুলো সংস্কৃত ভাষায় তাই টার্মগত ভিন্নতার কারনেও অনেকের এই মেডিসিন সিস্টেম সম্পর্কে ধারনা নেই। আমাদের মেডিকেলে প্রতিদিন মেজর এবং মাইনর অপারেশন থিয়েটার (ও টি) মিলিয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫-২০ টি সার্জারি হয়ে থাকে। অথচ অনেকে মনে করেন ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন সিস্টেমে সার্জারির কনসেপট নেই। আরেকটি মজার বিষয় শেয়ার করি, আপনার হাতের ফোনে ক্রম কিংবা অন্য কোন ব্রাউজার অথবা এ আই যেমন চ্যাট জিপিটি যেকোন একটিতে সার্চবারে “Who is the father of surgery” লিখে সার্চ করুন। “সুশ্রুত” নামটি চলে এসেছে তাই না। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে আচার্য সুশ্রুত হচ্ছেন সার্জারি বিশেষজ্ঞ। আর উনার তৈরি করা ইন্সট্রুমেন্ট মডেল গুলো মডার্ণ সার্জারিতেও ব্যাবহার হচ্ছে। আয়ুর্বেদিক সার্জন হতে হলে ব্যাচলরের পর ৩ বছরের এমএস (মাস্টার্স ইন সার্জারি) করতে হয়।
?দামস্ত্রা চিকিৎসাঃ যাকে আগদতন্ত্র বা বিষ চিকিৎসা ও বলা হয়ে থাকে। আরেকবার কষ্ট করে আপনার মোবাইল ফোনে ডিকশনারি তে “Toxicology” এর বাংলা অর্থটা সার্চ করুন, কি, বিষ বিদ্যা এবং আগদতন্ত্র চলে এসেছে তাই না? হ্যা, টক্সিকলজি এর ডিপার্টমেন্ট আয়ুর্বেদেও আছে তবে তা আগদতন্ত্র/দামস্ত্রা চিকিতসা/বিষ বিদ্যা নামে। ভ্যাক্সিনেসন রেবিলিউশন এর যুগে আগদতন্ত্র অনেকটাই কম প্র্যাকটিস হওয়ায় এই ব্রাঞ্চটি আরোও পেছনে পড়ে যাচ্ছে। তবে এখনো ভারতে অনেক ইউনিভার্সিটি তে পিএইচডি লেভেলেও আগদতন্ত্র পড়াশোনা এবং গবেশনা চলছে।
?জারা চিকিৎসাঃ বৃদ্ধদের স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা সংক্রান্ত বিভাগ কে জারা চিকিৎসা বিভাগ বলে। শিশু রোগ বিভাগটা অনেক বেশি হাইলাইটেড এবং এভেইলেবল হলেও বৃদ্ধ স্বাস্থ্য বিভাগটি বিরল। জারা চিকিৎসার ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে “Geriatrics” হয়তো দুইচারজন ইংরেজি প্রতিশব্দটা শুনে থাকবেন। জারা চিকিৎসায় খুব অল্প সংখ্যক স্পেশালিষ্ট থাকায় কায়া চিকিৎসা কিংবা স্বাস্থ্যবৃত্ত্ব ডিপার্টমেন্টে বৃদ্ধদের স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা নিশ্চিত করা হয়।
?বৃষ্যা চিকিৎসাঃ যারা ভাবতেন আয়ুর্বেদ মানে কেবল যৌন এবং চর্ম চিকিৎসা তারা হয়তো ভাবছেন , তবে কি আয়ুর্বেদে যৌন চিকিৎসা নেই! এতো এতো ভাষন দিয়ে দিল এখনো এই টপিক টা আসে নি। আয়ুর্বেদে বাকি সব চিকিৎসার মত যৌন চিকিৎসায় ও বেশ সুনাম রয়েছে। আর বিশেষ করে ভারতে ইনফার্টিলিটি , প্রসুতি বিজ্ঞান, স্ত্রী রোগ এইসবের ক্ষেত্রে বর্তমানে আয়ুর্বেদ বেশ নাম কামাচ্ছে এবং মানুষজন ও এইসব রোগের জন্য আয়ুর্বেদ কিংবা অন্যান্য ট্রেডিশনাল মেডিসিনের দিকে বেশি ঝুঁকছে। তাছাড়া “স্ত্রী রোগ এবং প্রসূতি তন্ত্র” ডিপার্টমেন্ট টি যদিও বৃষ্যা চিকিৎসার একটি উপবিভাগ তবে এরজন্যও এমডি এবং পিএইচডি ডিগ্রী মোটামোটি সব আয়ুর্বেদিক ইউনিভার্সিটিতে রয়েছে।
এই হচ্ছে আয়ুর্বেদা এর ৮ টি ব্রাঞ্চের ব্যাসিক ধারনা। তাছাড়াও এইসব ব্রাঞ্চের আরো অনেক উপব্রাঞ্চ রয়েছে যেগুলোতে মাস্টার্স এবং পিএইচডি পরিসরে পড়াশোনা হয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে পঞ্চকর্মা (বেশ বিখ্যাত), ব্যাসিক প্রিন্সিপাল, সামহিতা, স্বাস্থ্যবৃত্ত্ব, রোগনিদান (প্যাথলজি), রচনা শরীর (এনাটমি), ক্রিয়া শরীর (ফিজিওলজি) ইত্যাদি।
_ডা. মোঃ মাকসুদুর রহমান
মেডিকেল অফিসার (আয়ুর্বেদিক)
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
মুজিবনগর, মেহেরপুর।